
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরুণ ভোটাররা সবসময়ই একটি বড় শক্তি। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের মোট ভোটারের প্রায় ৩০ শতাংশ বা প্রায় চার কোটি তরুণ। এই ভোট জাতীয় নির্বাচনে হতে পারে অন্যতম নির্ধারক ফ্যাক্টর। গত এক বছরে নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত বিএনপির জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো তরুণ ভোটারদের আস্থা অর্জন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। এর পরের নির্বাচনগুলোতে তরুণরা তেমনভাবে ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। বিতর্কিত নির্বাচনগুলো তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। ফলে এবার প্রথমবার ভোট দেবেন এমন ভোটারের সংখ্যাও বেশি। বিএনপি নেতাদের মতে, দীর্ঘদিন ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত তরুণ প্রজন্মকেই সামনে রেখে তারা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়তে চান। এজন্য কর্মসংস্থান, জীবনমুখী শিক্ষা, বিদেশি ভাষা শিক্ষা, খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
ছাত্রদলের ব্যর্থতা ও শিক্ষণীয় দিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডাকসু) এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রদলের ভরাডুবি শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জনে দলের সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করেছে। সাংগঠনিক স্থবিরতা, প্রার্থী বাছাইয়ে দুর্বলতা, অন্তর্কলহ, নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি-দখলদারির অভিযোগ, গেস্টরুম কালচার এবং দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতির কারণে ছাত্রদল ব্যর্থ হয়। সাবেক ছাত্রদল নেতা রাশেদ ইকবাল খান স্বীকার করেছেন—সাংগঠনিক দুর্বলতা, পরিকল্পিত অনলাইন প্রচারণার অভাব এবং অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকাতে অক্ষমতাই এই বিপর্যয়ের কারণ। তবে এ ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে দলটি।
তরুণদের প্রত্যাশা
রাজধানীর ব্যবসায়ী হাসিবুল ইসলাম সোহাগ মনে করেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বিএনপি ও গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া দলগুলোর প্রতি তরুণদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। মাদক ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, কর্মসংস্থান, শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ পরিবেশ এবং ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলার পুনর্জাগরণ তরুণদের আস্থা ফেরাতে পারে।
বগুড়ার বাসিন্দা মামুনুর রশিদ মুকুল মনে করেন, সন্ত্রাস, দখলবাজি ও চাঁদাবাজি বন্ধ করে বেকার তরুণদের জন্য টেকসই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারলেই বিএনপি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করবে।
যুব উদ্যোগ ও কর্মসূচি
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল নিয়মিত কর্মসূচি পরিচালনার পাশাপাশি “আমরা বিএনপি পরিবার” ব্যানারে তরুণদের মেধা ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করছে। “সবার আগে বাংলাদেশ” ক্যাম্পেইনের আওতায় ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং কনসার্টের মাধ্যমে তরুণদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদল হেপাটাইটিস বি ভ্যাক্সিনেশন প্রোগ্রাম, ফ্রি হেলথ ক্যাম্প, ফুটবল ও ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট, নারী ফুটবল প্রতিযোগিতা এবং কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার মতো কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে।
যুবনীতি ও কর্মসংস্থান পরিকল্পনা
বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফার মধ্যে ২২ দফা সরাসরি যুব সমাজকে কেন্দ্র করে।
-
এক বছরের বেকার ভাতা।
-
আঠারো মাসে এক কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টির অঙ্গীকার।
-
যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি নিশ্চিতকরণ।
-
আত্মকর্মসংস্থানের জন্য সহজ ঋণ ও উদ্যোক্তা তৈরির প্রকল্প।
-
প্রযুক্তিনির্ভর স্টার্টআপ ফান্ড ও ইনকিউবেশন সেন্টার।
-
কৃষি ও শিল্পখাতে তরুণদের সম্পৃক্ততা।
-
বিদেশি ভাষা শিক্ষা, টেকনিক্যাল কোর্স ও ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ।
সংস্কৃতি, ক্রীড়া ও সামাজিক কল্যাণ
বিএনপি হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা যেমন নৌকাবাইচ, হাডুডু ফিরিয়ে আনতে চায়। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সুস্থ বিনোদনের ব্যবস্থা করছে। তরুণদের মাদক থেকে দূরে রাখতে সামাজিক আন্দোলন ও নৈতিক মূল্যবোধের প্রসারে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
তারেক রহমানের দৃষ্টিভঙ্গি
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রচলিত স্লোগান নির্ভর রাজনীতির সমাপ্তি ঘটিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন। তরুণদের জন্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা, বিদেশি ভাষা শিক্ষা, স্টার্টআপ ফান্ড, ইনকিউবেশন সেন্টার এবং খেলাধুলাকে পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তার মতে, তরুণদের রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ত করে রাষ্ট্রগঠনের অংশীদার বানানোই বিএনপির লক্ষ্য।